অটো ডিজাইনারদের কল্পনা: ২০০৭ সালে ২০৫৭ সালের গাড়িগুলোর ভবিষ্যদ্বাণী কীভাবে করা হয়েছিল
২০০৭ সালে লস অ্যাঞ্জেলেসে Auto Show Design Challenge-এ শীর্ষস্থানীয় গাড়ি নির্মাতারা জড়ো হয়েছিলেন নতুন উৎপাদিত মডেল প্রদর্শনের জন্য নয়। এটি ছিল ধারণা, কনসেপ্ট এবং কল্পনার একটি শো — একপ্রকার ভবিষ্যতের প্রদর্শনী, যেমনটি প্রায় দুই দশক আগে ডিজাইনার এবং প্রকৌশলীরা কল্পনা করেছিলেন। তখন বাজেট বা প্রযুক্তিগত বাস্তবায়নের কোনও সীমাবদ্ধতা ছিল না — শুধুই সৃজনশীলতা। কেমন হবে ৫০ বছর পরের সড়কপথ — সেই দৃষ্টিতে তাকানোটা বেশ রোমাঞ্চকর। হতে পারে, এসব ধারণার কিছু অংশ আমরা বাস্তবে এখনও দেখতে পাব।
Audi একটি এক আসনের কনসেপ্ট গাড়ি উপস্থাপন করে, যা পরিবেশবান্ধব হাইড্রোজেনে চলে। কিন্তু এর প্রধান বৈশিষ্ট্য — ইঞ্জিন নয়। ডিজাইনাররা একটি হোলোগ্রাফিক বডি কল্পনা করেছেন, যা মালিক নিজের পছন্দমতো কাস্টমাইজ করতে পারবেন। রং, আকৃতি, স্টাইল — সবকিছুই গেমের স্কিনের মতো বদলানো যায়। শত শত ডিজাইনের সমন্বয়ে তৈরি করা যায় ইউনিক কম্বিনেশন। এই ভবিষ্যতধর্মী প্রকল্পটি তৈরি হয়েছিল ক্যালিফোর্নিয়ার Audi/Volkswagen Design Center-এ।
General Motors নিরাপত্তাকে কেন্দ্রে রেখে ANT কনসেপ্ট তৈরি করে — Advanced Networked Transportation-এর সংক্ষিপ্ত রূপ, আর ইংরেজিতে “পিঁপড়ে” শব্দের সঙ্গেও মিলে যায়। এই গাড়ি নাকি তিন কিলোমিটার দূরের ট্রাফিক পরিস্থিতি বুঝে রুট ও মুভমেন্ট স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিবর্তন করতে পারে। এটি তিনটি স্বাধীন চাকার মাধ্যমে ‘Nanorb’ প্রযুক্তিতে চলে — যে কোনও দিকে চলাচল সম্ভব। তাত্ত্বিকভাবে এটি চমৎকার শোনালেও, বাস্তবে হয়তো এটি কয়েকশ মিটার গিয়েই ঘুরপাক খেতে শুরু করবে — রাস্তার বাস্তবতা তো থেকেই যাচ্ছে।
Mazda একটি ভবিষ্যতধর্মী কনসেপ্ট উপস্থাপন করে এবং অন্যান্যদের চেয়ে আলাদা হয়ে তারা একটি পূর্ণাঙ্গ ডকুমেন্টেশন ও প্রস্তাবিত মূল্যও দেয়। এর বিশেষত্ব — এমন একটি সিস্টেম, যা ড্রাইভারের শরীর ও রাস্তার মধ্যকার সংযোগকে বৃদ্ধি করে। লক্ষ লক্ষ মাইক্রো সেন্সরের সাহায্যে এটি ড্রাইভারের মাংসপেশিতে ইলেকট্রিক সিগনাল পাঠায়, যাতে রাস্তায় চলার অভিজ্ঞতা অনুভব করা যায়। এ ধরনের প্রযুক্তি গাড়িচালকের সঙ্গে আরও গভীর সংযোগ তৈরি করতে পারে, যদিও খারাপ রাস্তার জন্য এটি জনপ্রিয় না-ও হতে পারে।
জাপানের Honda পরিচিত কায়দায় উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা নিয়ে আসে। তাদের কনসেপ্ট চারটি স্বয়ংক্রিয় মডিউলের সমন্বয়ে তৈরি, যা একত্রে একটি গাড়ি গঠন করে। আপনি সহকর্মীদের সঙ্গে থাকলে — একসঙ্গে যাত্রা করবেন। আলাদা হতে চাইলে — প্রত্যেকে নিজের পথে। এই ধারণাটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে, কিন্তু ভবিষ্যতের দুনিয়ায় এমন নমনীয়তা হয়তো খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
Mercedes-এর ইঞ্জিনিয়াররা আরও একধাপ এগিয়ে যান এবং গাড়িচালকদের দুটি চিরন্তন সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন: ক্ষতি ও পার্কিং। গাড়ির বডি তৈরি হয় চৌম্বকীয় ন্যানোপার্টিকেল দিয়ে, যা রূপ পরিবর্তন ও স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনর্গঠন করতে পারে। গাড়ি ভেঙে গেলে — একটি বোতামে সব আগের মতো হয়ে যায়। আর যদি লুকিয়ে রাখতে চান — এটি তরল ধাতুতে রূপান্তরিত হয়। কল্পনা করুন: একটি গাড়ি, যেটিকে আপনি বালতিতে ভরে আলমারিতে রাখতে পারেন। টার্মিনেটর খুশি হতেন।
Nissan প্রকৃতি থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে এমন একটি কনসেপ্ট তৈরি করে যা গাড়ি এবং প্রাণীর সংকর। এটি কোম্পানির ভাষায় “পারিবারিক পোষা প্রাণী” — চাকার বদলে এটি কৃত্রিম “পায়ে” চলে, যা পেশির মতো কাজ করে। গতি বাড়ালে গাড়ি নিচে নেমে যায়, বায়ু প্রতিরোধ কমে যায়; গতি কমালে আবার উঠে যায় স্থিরতার জন্য। এটি কেবল পরিবহণ নয়, বরং একটি বুদ্ধিমান সঙ্গী।
Toyota সৃজনশীলভাবে পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি কনসেপ্ট তৈরি করে, যা বর্জ্য পদার্থ থেকে জ্বালানি তৈরি করে। হ্যাঁ, সত্যিই — ময়লা হচ্ছে জ্বালানি। তদুপরি, গাড়িটি ন্যানোটেকনোলজির মাধ্যমে নিজের আকৃতি পরিবর্তন করতে পারে। চাকাগুলো তৈরি হয় ন্যানোলেজার দিয়ে, যা যেকোনো দিকে চলাচল নিশ্চিত করে। এটি ড্রাইভারের প্রয়োজন অনুসারে নিজের রূপও পাল্টাতে পারে, এমনকি বিছানাতেও। কেবল প্রযুক্তিকে যথাযথ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়াই বাকি — আর জাপানিরা সে কাজে ধৈর্য ও নিষ্ঠায় পারদর্শী।
এই কনসেপ্টটি শো-এর বিজয়ী হয়। অবাক হওয়ার কিছু নেই — এর সামনের দিক, পিছনের দিক, চাকা ও চালক কোথায় তা বলা মুশকিল। এর মূল বৈশিষ্ট্য — পরিবেশ অনুযায়ী নিজেকে মানিয়ে নেওয়া। শহরে এটি উঁচু হয়ে যায় কম জায়গায় চলার জন্য, আর হাইওয়েতে এটি নিচু হয়ে এরোডাইনামিক রূপ ধারণ করে এবং ২৫০ মাইল/ঘণ্টা গতিতে চলতে পারে। চালানো আরামদায়ক: বসুন, রিল্যাক্স করুন, সব কিছু গাড়িই সামলাবে। শক্তির উৎস — সৌর প্যানেল। কোনও পেট্রোল স্টেশন বা জ্বালানি সংকট নেই।
এই সব কনসেপ্ট এখনও অনেকটাই সায়েন্স ফিকশন মনে হতে পারে। কিন্তু মনে রাখুন: দেড়শো বছর আগে ঘোড়াবিহীন গাড়িকে পাগলামি মনে করা হতো। আর আজ, গাড়ি ছাড়া জীবন অসম্পূর্ণ। কে জানে, হয়তো ৩০ বছর পর এইসব "কল্পনা" বাস্তবেই রূপ নেবে।